টেনেটুনে পাস আসিফ মাইক্রোসফটের সফল ইঞ্জিনিয়ার, গুগলকেও না!  

জীবনে কখনো ভাবিনি যে ছোট বেলার স্বপ্নের কোম্পানি গুগল থেকে আমার ইন্টারভিউয়ের জন্য অফার আসবে আর আমাকে তা ফিরিয়ে দিতে হবে। তার পিছে কারণও ছিলো অবশ্য, সেটা পরেই বলি।

আমার শৈশব কাটে সাতক্ষীরাতে। বাবা মা ছিলেন চাকরিজীবী। স্কুল জীবনে কখনও তেমন আহামরি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম না। তৃতীয় শ্রেণিতে যখন সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয় তখন ক্লাসের শেষ ছেলেটি ছিলাম আমি, রোল ছিল ৫৭। পরের শ্রেণিগুলোতেও এই অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। একটি মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের সব থেকে বড় অভিভাবক হওয়ার কারণে বাবা-মার অনেক দায়িত্ব ছিল, যে কারণে আমার প্রতি কখনো এক্সপেক্টেশন রাখতেন না। আমার যেদিকে ইচ্ছা ওইদিকেই লাইফ গোল সেট করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। যেই বিষয় আমার ভালো লাগতো, কেবল ওই বিষয়টাই বেশি পড়তাম সবসময়। যে কারণে একটা বিষয়ে ভালো ফলাফল আসলেও বাকিগুলোতে টেনেটুনে কেবল থার্ড টার্ম পরীক্ষায় পাস করেও পরের ক্লাসে উঠছি এমন অনেকবার ঘটেছে। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান এবং টেকনোলজির প্রতি আগ্রহ আমার খুব বেশি ছিল। এখনও মনে আছে ক্লাস সিক্সে একবার একটি টেলিফোন বানিয়েছিলাম নিজের পেট প্রোজেক্ট হিসেবে। এইভাবেই কাটে স্কুল জীবন। কলেজে উঠে প্রথম কম্পিউটার পাই। কলেজ প্রথম বর্ষে বন্ধু শুভর কাছ থেকে পাওয়া “নিটনের সি” বইটি দেখে কিছু বেসিক প্রোগ্রাম লিখছিলাম। তখন থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন বুনতে শুরু করি। এবং মাইক্রোসফট, গুগলের মত কোম্পানিগুলোতে কোটি মানুষের জীবন সহজ করার সফটওয়্যার বানানোর দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকতাম।

কলেজ শেষে এইচএসসি-তে রেজাল্ট তেমন ভাল হল না। বুয়েটের ফর্ম তুলতে পারলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেও মা জোর করলে রুয়েট, কুয়েটের ফর্ম তুলি। ভাগ্যক্রমে রুয়েটে স্বপ্নের ডিপার্টমেন্ট কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার সুযোগ পেলাম। রুয়েট জীবন নিয়ে গল্প বলতে গেলে কয়েক রাত পার করে দেয়া যাবে। ডিপার্টমেন্টে আমি খুবই ভাল একটা ফ্রেন্ড সার্কেল পাই, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী বন্ধু পাই। পাশাপাশি হল লাইফটাও এনজয় করতে থাকি। রুয়েট লাইফটা জুনিয়র, সিনিয়র, ক্লাসমেটদের জন্যই মূলত আনন্দমুখর ছিলো। সেলিম হল, হামিদ হল, টিনশেড হলে থাকার মুহূর্তগুলো ছিল অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে সন্ধ্যায় কারেন্ট চলে গেলেই টিনশেড হলের মাঝে গোল চত্বরে বসে সবাই মিলে বসে গান, মাঝে মধ্যে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে গিটার বাজানো, রাতে ১৫-২০ জন মিলে রাজশাহীর গলিতে গলিতে ঘুরে গান গাওয়া আজও মিস করি।

রুয়েটে এসে সিনিয়রদের কাছ থেকে কমপিটেটিভ প্রোগ্রামিং-এর সাথে পরিচয় ঘটে। প্রোগ্রামিং করতে গিয়ে খেয়াল করলাম গণিতে আমার ব্যাসিক খুবই দুর্বল। সে সময় ক্লাস ৯-১০ এর গণিত বই থেকে শুরু করলাম। রুয়েটে আমাদের প্রোগ্রামিং এর জন্য তেমন সুবিধা ছিলনা। একটা অ্যালগরিদম শিখতে দেখা যেত ২-৩ সপ্তাহ লাগতো। এরপর আমরা একজন শিখে আরেকজনকে সেটা শেখাতাম। সে সময়টা প্রোগ্রামিং শেখার জন্য বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল। অনেকবার এমনও হয়েছে যে নিজের টাকা দিয়ে প্রোগ্রামিং কনটেস্ট করতে গেছি আমরা যেখানে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি সব টীমগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অর্থায়ন করে কনটেস্টে পাঠানো হতো। মনে পড়ে আমাদের অ্যালগরিদম চর্চা করার কোন জায়গা না থাকায় রুয়েট প্লে-গ্রাউন্ডে বসে জুনিয়রদের সাথে হোয়াইট বোর্ড নিয়ে এক সাথে আলোচনা করার কথা। অনেক প্রচেষ্টার পর ফোর্থ ইয়ারে এসে আমাদের সবার এত বছরের চেষ্টা দেখে হেড স্যার আমাদের একটা ল্যাব দেন চর্চা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি ল্যাবের নাম দেন এনালাইটিক্যাল প্রোগ্রামিং ল্যাব। এটা হয়ে উঠেছিলো আমাদের প্রোগ্রামিং হাব। রাজশাহীর গরমে মশার কামড় খেয়ে এই ল্যাবে জুনিয়রদের সাথে সারা রাত জেগে প্রোগ্রামিং করে ভোরবেলা তালাইমারী যেয়ে এক কাপ চা খাওয়ার স্মৃতিগুলো মনে পড়লে এখনও মুখের কোণে একটা হাসি চলে আসে। এই ল্যাবেই আমরা অনেক রকম অ্যাক্টিভিটি করতাম, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “জ্ঞান-jam” নামক কনটেস্টটি। প্রতিবছর বিদায়ী ব্যাচের দায়িত্ব থাকে বিদায়ের আগে একটা “জ্ঞান-jam” আয়োজন করা। ভাবলেই খুবই গর্ব হয় যে সেই সংস্কৃতিটা জুনিয়ররা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রোগ্রামিংয়ের পাশাপাশি আমরা RUET জীবনটা আরও মজার করার জন্য বেশ কয়েকটি সংগঠন বানাই সবাই মিলেই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Science and Astronomy Society of RUET (ASSR), চিরকুমার সংঘ, সমানুপাতিক, প্রচেষ্টাসহ বেশ কিছু সংগঠন।

আমি রুয়েটে এসে নিজস্ব "Reason to Live" নামের একটি লিস্ট তৈরি করি। কেউ আমাকে কোন কিছু পারবো না এমন কিছু বললে আমি সেটা লিখে রাখতাম। যদি কখনও ভুল প্রমাণ করতে পারি এটা ভেবে। আলহামদুলিল্লাহ বেশ অনেকগুলোই ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি। ফোর্থ ইয়ারে উঠে একবার একটা কনটেস্টে একটা প্রবলেমও সলভ করতে পারল না আমাদের টিম, আমরা খুবই লজ্জায় পড়ে যাই। ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষিকা ক্লাসে সবার সামনে অপমান করে বলছিলেন, “রুয়েট থেকে কখনও কেউ গুগল মাইক্রোসফটে চাকরি পাবে না। তাই পড়াশোনায় মনোযোগ দাও”। কথাটা খুবই গায়ে লেগেছিলো। সেটা শোনার পর আমার এক বন্ধু রবিকে বলেছিলাম শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবো আমি মাইক্রোসফট বা গুগলে যাওয়ার জন্য।

ক্যারিয়ারের শুরুটা হয় শেষ সেমিস্টার শুরুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জব ফেয়ারে সেলিস রকিং সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পাই। জীবনের মোড়টা ঘুরে সুইডেনের অ্যাডফেনিক্স এবি নামক স্টার্টআপে চাকরির মাধ্যমে। প্রথমে দেশ ছাড়া লাগবে ভেবে রিজেক্ট করার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু সবার পরামর্শে এক্সেপ্ট করি। একটু ভ্রমণপিপাসু হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরে চাকরি অফার আসলেও ইউরোপকেই বেছে নিয়েছিলাম। এরপর সুইডেনের স্বনামধন্য ন্যাসডাক কোম্পানিতে চাকরি পাই। এর মাঝেই ২৩ মার্চ, ২০১৮ তে ডাক আসে স্বপ্নের কোম্পানি থেকে। ফোনে যখন বলল মাইক্রোসফট কোম্পানি থেকে বলছেন, আমি ভেবেছি আমি হয়তো ভুল শুনেছি। বিশ্বাস হচ্ছিল না, উত্তেজনায় জিজ্ঞাস করে বসি,"তুমি সিরিয়াসলি মাইক্রোসফট থেকে বলছো?" চাকরি পাওয়ার খবর জানাতে ফোন দেই মা-বাবাকে। মা-বাবাকে চাকরির খবর দেয়ার পর খেয়াল করলাম আমার চোখে পানি চলে এসেছে। জীবনের এতো সময় পর আমি প্রথম বুঝতে পারলাম এটাই আনন্দের অশ্রু। অবশেষে ডেনমার্কে এসে জয়েন করি স্বপ্নের কোম্পানিতে। দিনটি ছিল ঈদের দিন। আমার জীবনের বেস্ট ঈদ। ইনফ্যাক্ট বেস্ট মোমেন্ট।

এবার আসি কেন আর একটা স্বপ্নের কোম্পানির ইন্টারভিউ অফার আমাকে রিজেক্ট করতে হলো। মাইক্রোসফটে জব হওয়ার ঠিক তিন মাসের মধ্যেই গুগল থেকেও ইন্টারভিউ-এর ডাক আসে। কিন্তু কেবলই মাইক্রোসফটে জয়েন করার কারণে গুগলে আর ইন্টারভিউ দেয়া হয়নি। রিক্রুটারের সাথে এখনও মাঝে মধ্যে কনট্যাক্ট হলেও মাইক্রোসফট ছাড়ার মন এখনও হয় নাই।

আমির খানের থ্রি ইডিয়টস মুভিটা আমার খুবই প্রিয় একটা মুভি। এই মুভিতে যেমনটা দেখেছিলাম, আমি খুব করে চাইতাম এমন কিছু যেন আমার সাথেও হয়। এখন নিজের পছন্দের কাজ করছি, পৃথিবীর অন্যতম সেরা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস থাকলেও অনেক সময়েই আমি রাত ৯টা পর্যন্ত অফিস করি। আমার কাজ আমার এতো প্রিয় বলেই হয়ত টের পাইনা সময় কখন চলে যাচ্ছে। বছর খানেক আগে ডেনমার্কে একটি শিক্ষক সেমিনার আয়োজন করে মাইক্রোসফট যেখানে আমাকে একটা টক দেয়া লাগছিল। আমি সেখানে গিয়ে রুয়েটে আমার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করি। কিভাবে রুয়েটে RAPL, ASSR এর মত শিক্ষণীয় সংগঠনগুলো তৈরি করেছিলাম আমরা। সবাই বেশ মুগ্ধ হয়ে আমাদের কাহিনীগুলো শুনেছিলেন।

অন্য সবার মতই রুয়েটে থাকা অবস্থায় অনেক সময় নিজের মধ্যে হতাশা কাজ করত। মনে হত, যদি আশে পাশে কোন নিদর্শন থাকতো যাকে দেখলে মনে হতো যে আমরাও পারবো। সে সময়ে সামাদ ভাই, মুফতি ভাই, রিফাত ভাই, মেরিন ভাই সহ বেশ অনেকে ছিলেন যাদের অনুপ্রেরণায় নিজেকে অনেক বড় জায়গায় কল্পনা করতে পারতাম। এক-একজন মানুষের কাছে সফলতার মাপকাঠি এক-একরকম। প্রতিটা মানুষ তার নিজের মত করে সফল হয়। আমার মতে আমার মত below average একটা ছাত্রের মাইক্রোসফটে আসাকে যদি সত্যিই সফলতা মনে হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলবো রুয়েটে প্রতিটা স্টুডেন্ট এর এই পটেনশিয়াল আছে।

লেখক: সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, মাইক্রোসফট

সাবেক শিক্ষার্থী, রুয়েট

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নারীর মুক্তি ও সমতার জন্য অন্তর থেকে পরিবর্তন আনতে হবে : মঈন খান Aug 18, 2025
img
আজ দেশে কত দামে স্বর্ণ ও রুপা বিক্রি হচ্ছে? Aug 18, 2025
img
খেলাধুলায় যুক্ত থাকলে যুবসমাজ বিপথগামী হবে না : সেনা প্রধান Aug 18, 2025
img
আসন্ন এশিয়া কাপে ভারতকে হারাবে পাকিস্তান, বিশ্বাস আকিব জাভেদের Aug 18, 2025
img
প্রথমবার সিনেমার নায়িকা চরিত্রে রুনা খান Aug 18, 2025
img
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন জেলেনস্কি Aug 18, 2025
img
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় একদিনে প্রাণ গেল আরও অন্তত ৪৭ জনের Aug 18, 2025
img
১ যুগ পর নাসিরুদ্দিনের অপমানের জবাব দিলেন ফারহান Aug 18, 2025
img
বাহরাইনের বিপক্ষে আজ মাঠে নামছে বাংলাদেশ Aug 18, 2025
img
'ইউক্রেনকে শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে রাজি পুতিন' Aug 18, 2025
img
জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেন সুনীল ছেত্রী Aug 18, 2025
img
বিশ্বে বায়ুদূষণে শীর্ষ শহর রিয়াদ, ঢাকার অবস্থান ২৭তম Aug 18, 2025
img
দুপুরের মধ্যে দেশের ৭ জেলায় ৬০ কি.মি. বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস Aug 18, 2025
img
মাত্র তিন দিনেই ৭ কোটি রুপির ঘরে ‘ধূমকেতু’ Aug 18, 2025
img
ঢাকায় হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা, আকাশ থাকবে আংশিক মেঘলা Aug 18, 2025
img
টাঙ্গাইলে যুবলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৩ Aug 18, 2025
img
জয় দিয়ে নতুন মৌসুম শুরু করল পিএসজি Aug 18, 2025
img
চট্টগ্রামে পিকআপ ও কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষে প্রাণ গেল ৪ জনের, আহত ৩ Aug 18, 2025
img
নির্বাচনের হাওয়া সারা বাংলাদেশে বইছে : গিয়াস উদ্দিন Aug 18, 2025
img
জেআরপিতে ৪৫৫ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় Aug 18, 2025